মন্দ ধারণা ও তার কুফল

Rumman Ansari   2023-03-20   Developer   islam > Evil thoughts and their consequences   172 Share

আজ আমরা এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো, যার অশুভ পরিণতি আমরা ভোগ করে চলেছি ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবন পর্যন্ত। আর তা হলো অন্যের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করা। এই মন্দ ধারণার কারণে ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবন পর্যন্ত আমরা আজ অশান্তির আগুনে জ্বলছি।

সামাজিক জীবনে আমাদের পারস্পরিক আন্তরিকতা বজায় রাখতে হবে। অযথা সন্দেহ পোষণ থেকে বিরত থাকতে হবে। অনুমান নির্ভর ও গুজবের উপর ভর করে সমাজে অঘটনের অনেক নযীর আছে। কথার সত্যতা যাচাই না করেই অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার রচনার অপতৎপরতাও সমাজে কম নয়। মানব হিসাবে আমাদের উচিত নিজেদেরকে মন্দ ধারণা থেকে পরহেয করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করা। ফলে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে, অটুট থাকবে মানবসুলভ ভ্রাতৃত্ববোধ।

মন্দ ধারণা কি?

মন্দ ধারণা তাকেই বলে যে ধারণার স্বপক্ষে বাহ্যিক কোন কারণ কিংবা সুস্পষ্ট কোন প্রমাণ নেই।

কথা ও কাজের ক্ষেত্রে মর্ম ও উদ্দেশ্যই যেহেতু মূল বিবেচ্য বিষয়, সেহেতু অন্যের কথা ও কাজের মর্ম ও উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা না করে, কোনো ওজর বা সমস্যা ছিলো কি না তা তালাশ না করে অন্যের কথা ও কাজের মন্দ দিকটাকে বড় করে প্রকাশ করাই হলো মন্দ ধারণা।

মন্দ ধারণা হল যেখানে একটি ব্যক্তি অবশ্যই নিজেকে সম্পূর্ণ সঠিক মনে করে এবং অন্যদের মতো ভাবতে পারে না। এই ধরণের মানসিক অবস্থা থাকলে ব্যক্তির সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে সমস্যা হতে পারে কারণ একটি ব্যক্তি যদি নিজেকে সম্পূর্ণ সঠিক মনে করে তবে সে অন্যদের মতো ভাবতে পারে না এবং তাদের সঙ্গে ঠিকমত সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারে না।

বিবেচিত ব্যক্তি

বাহ্যিকভাবে যার মধ্যে সততা, সত্যবাদিতা ও আমানতদারী পরিলক্ষিত হয় তার সম্পর্কে ফাসাদ ও খিয়ানতের ধারণা পোষণ করা হারাম বলে বিবেচিত হবে।

যদি কারো মধ্যে সুষ্পষ্টভাবে খিয়ানত পরিলক্ষিত হয় এবং তার স্বভাব-প্রকৃতিও মন্দ হয়, আর এ ব্যাপারে যদি সমাজে তার কুখ্যাতিও থাকে তাহলে এমন লোক সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করা হারাম হবে না।

মনের খবর জানা এবং সে বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার তো কোন মানুষের নেই। মানুষের মনের সুপ্ত বিষয় ও গোপন ইচ্ছা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই জানেন। সুতরাং এসব বিষয়ে হিসাব-নিকাশের অধিকারও একমাত্র আল্লাহর। মানুষের কর্তব্য হলো জাহির বা বাহ্যিক অবস্থার ওপর সিদ্ধান্ত দেয়া।

মন্দ ধারণার উদাহরণ

  • কারো মধ্যে যখন মন্দ ধারণা পোষণের ধ্বংসাত্মক ব্যাধি অনুপ্রবেশ করে তখন সে ব্যাধি খুব দ্রুত তাকে অন্যের প্রতি অপবাদ আরোপে উদ্বুদ্ধ করে ফলে সে অন্যের দোষ-ত্রুটি ও গোপন বিষয় অনুসন্ধানের ঘৃণিত কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাই দেখা যায়, কেউ যখন মন্দ ধারণা পোষণ করে তখন সে বলে ঘটনাটি আমি যাচাই করে দেখব। এরপরই সে অন্যের গোপন বিষয় জানার ঘৃণিত কাজে লেগে পড়ে এবং গীবত শুরু করে দেয়। তখন শুধু অন্যের মন্দ দিকগুলোই সে আলোচনা করে।
  • অমুক লোক এই কাণ্ড ঘটিয়েছে,
  • অমুক লোক এ ভালো কাজ করতেই পারে না,
  • অবশ্যই তার কোনো গোপন উদ্দেশ্য রয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

মন্দ ধারণা সৃষ্টি হওয়ার বাহ্যিক কিছু কারণ

  • মানুষ যখন মন্দ চরিত্রের অধিকারী এবং মন্দ ধারণা পোষণকারী লোকদের পরিবেশে বেড়ে ওঠে তখন তার মাঝেও এ অশুভ প্রকৃতি লালিত হয়।
  • আর খারাপ বন্ধু-বান্ধবের সাথে ওঠা-বসা করলেও মানুষের মধ্যে বিভিন্ন মন্দ গুণের সৃষ্টি হয়।
  • এছাড়া মানুষ যখন নফসের অনুসরণ করে তখনও সে ভিত্তিহীন ধারণা পোষণে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কেননা কোন কিছুর ভালোবাসা সেক্ষেত্রে মানুষকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে দেয়। তাই দেখা যায় নফসের অনুসরণ করে মানুষ যখন কারো প্রতি ঝুঁকে পড়ে তখন সে ঝোঁক ও আকর্ষণ তাকে সেই ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি ভুলিয়ে দেয়। ফলে সে আর ঐ ব্যক্তির দোষ-ত্র“টি দেখতে পায় না। আর এই ঝোঁক ও আকর্ষণ তাকে ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে সুধারণা পোষণে উদ্বুদ্ধ করে যদিও বাস্তবে ঐ ব্যক্তি ভুল করে থাকে।
  • অপর দিকে মানুষকে যখন কেউ রাগিয়ে দেয়, তখন সে ঐ লোককে আর ভালোবাসে না।
  • আর কারও প্রতি হৃদয়ের ঝোঁক হারিয়ে ফেলাই ঐ লোক সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করা এবং ঐ লোকের ভুল-ত্রুটি তালাশে প্ররোচিত করে। যদিও বাস্তবে লোকটি সৎ ও নির্দোষ হয়।
  • এমন মানুষ অহরহই পাওয়া যায়, যে নিজের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ ও ধোকাগ্রস্ত। ফলে সব সময় সে মনে করে, আমি হকের ওপর আছি, আর অন্যরা আছে বাতিলের উপর। সে নিজকে পবিত্র ভাবে এবং অন্যদেরকে দেখে ঘৃণার চোখে। এ প্রকৃতিটি তার মধ্যে অন্যের প্রতি ভয়ানক ধরণের মন্দ ধারণা পোষণের মানসিকতা তৈরি করে।

মন্দ ধারণার কুফল

  • মন্দ ধারণা কখনই কোন কল্যাণ বয়ে আনে না বরং তা হিংসা -বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি করে। আর এই ধারণা ও অনুমান এবং সন্দেহ-সংশয় সমাজে ঘৃণা ও নিন্দার উনুনে জ্বালানী সরবরাহ করছে।
  • পাস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করে, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে এবং ভ্রাতৃত্ববোধ ধ্বংস করে দেয়। সমাজের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে অন্যের বিষয়ে সংশয়- সন্দেহ দানা বাঁধছে এবং ঘৃণা ও অবজ্ঞার সৃষ্টি করছে।
  • আত্মীয়তার বন্ধন কেটে যাচ্ছে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট হচ্ছে।
  • সমাজের নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিবর্গের নির্ভরতা হ্রাস পাবে এবং নিজদের মাঝে হিংসা- বিদ্বেষ ও শত্রুতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
  • যে মন্দ ধারণা পোষণ করে সে গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আর এক গুনাহ অন্য গুনাহর দিকে টেনে নেয়। এভাবে মন্দ ধারণা পোষণকারী বিভিন্ন অন্যায়-অপরাধ ও পাপে জড়িয়ে পড়ে। আর পরিণতিতে এ মন্দ ধারণাই তার জন্য লাঞ্ছনা ও অনুশোচনার কারণ হয়।

আমাদের করণীয়

  • বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
  • উন্নত মননের অধিকারী হতে হবে।
  • পরস্পরের প্রতি ভালো ধারণা রাখতে হবে।
  • সবার সাথে হাসিমুখে, স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়ে কথা বলা এবং দেখা-সাক্ষাৎ করা।
  • সকল প্রকার সংশয়-সন্দেহ থেকে দূরে অবস্থান করতে হবে, মন্দ ধারণার পংকলিতা এবং সন্দেহ-সংশয়ের আবিলতা মুক্ত নির্মল ও স্বচ্ছ ভালোবাসা বিদ্যমান করতে হবে।
  • ধারণা ও অনুমানভিত্তিক আলাপ-আলোচনা হতে আমাদের দূরে থাকতে হবে।
  • মন্দ ধারণার বশবর্তী হয়ে কারো সম্পর্কে মুখে কিছু উচ্চারণ তো করা যাবেই না, উপরন্তু মন্দ ধারণা সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে তা থেকে সরে আসা এবং হৃদয়ের ভিতরে থাকা অবস্থায়ই তা দূর করে ফেলার প্রতি তাগিদ রাখতে হবে।
  • নিজদের পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত ও সুদৃঢ় রাখা এবং ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনকে পর্বতের মত অটল, অবিচল রাখা।
  • মন্দ ধারণা থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো, যে কোন অবস্থায় মানুষের প্রতি সুধারণা পোষণ করা। আর কারো সম্পর্কে কোন মতামত বা সিদ্ধান্ত দেয়ার আগে ভালো করে চিন্তা ভাবনা করা এবং মন্দ ধারণা পোষণ করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা। কারণ মন্দ ধারণা করে ভূল করার চেয়ে সুধারণা পোষণ করে ভুল করা উত্তম।
‘তোমার মু’মিন ভাইয়ের কথার যদি ভালো উদ্দেশ্য গ্রহণের কোন অবকাশ পাও তাহলে মন্দ উদ্দেশ্য গ্রহণ করো না’।
  • মন্দ ধারণা থেকে পরিত্রাণের আরেকটি উপায় হলো খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে মানুষের দোষ-ত্রুটি তালাশ না করা। মন্দ ধারণা সৃষ্টি হয় এমন কোনো কাজ যদি কেউ করেও বসে, তাহলেও মনে করা যে, বৈধ কোনো ওজর বা অপারগতাবশত হয়তো সে এরূপ করেছে।
  • মানুষের বাহ্যিক ও প্রকাশ্য অবস্থার ওপর নির্ভর করেই কারো সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত প্রদান করা। আর যা কিছু অভ্যন্তরীণ-অপ্রকাশ্য তা আল্লাহর কাছে সোপর্দ করা। আর নিজের সন্তানকে মানুষের ব্যাপারে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে ইসলামী শিষ্টাচার ও আদব-আখলাকের অনুকরণ অনুসরণের ওপর গড়ে তোলা।

আমাদের উচিৎ নিজদের কথা ও কাজের হিসাব নেয়া, কার ব্যাপারে কি ধারণা পোষণ করছি তার হিসাব নেয়া। কার ব্যাপারে কী মন্তব্য করছি তা খুঁটিয়ে দেখা। আর সব সময় কুরআনের এ আয়াতটি স্মরণ রাখা :

"যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় ওদের প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে।" "And do not pursue that of which you have no knowledge. Indeed, the hearing, the sight and the heart - about all those [one] will be questioned."

১৭ সূরাঃ আল-ইসরা (বনী-ইসরাঈল) | Al-Isra | سورة الإسراء - আয়াতঃ ৩৬

যারা বিনা অপরাধে বিশ্বাসী (মুমিন) পুরুষ ও নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা অবশ্যই মিথ্যা অপবাদ এবং স্পষ্ট অপরাধের বোঝা বহন করে। "And those who harm believing men and believing women for [something] other than what they have earned have certainly born upon themselves a slander and manifest sin. [Sahih International]

৩৩ সূরাঃ আল-আহযাব | Al-Ahzab | سورة الأحزاب - আয়াতঃ ৫৮

হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা বহুবিধ ধারণা হতে দূরে থাক; কারণ কোন কোন ধারণা পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা (গীবত) করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভায়ের গোশত ভক্ষণ করতে চাইবে? বস্তুতঃ তোমরা তো এটাকে ঘৃণ্যই মনে কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু। "O you who have believed, avoid much [negative] assumption. Indeed, some assumption is sin. And do not spy or backbite each other. Would one of you like to eat the flesh of his brother when dead? You would detest it. And fear Allah; indeed, Allah is Accepting of repentance and Merciful. [Sahih International]"

৪৯ সূরাঃ আল-হুজুরাত | Al-Hujurat | سورة الحجرات - আয়াত নং - ১২

যারা সতী-সাধ্বী রমনীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং চারজন সাক্ষী হাজির করেনা, তাদেরকে আশিটি কশাঘাত করবে এবং কখনও তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবেনা; তারাই সত্যত্যাগী। মুজিবুর রহমান
And those who accuse chaste women and then do not produce four witnesses - lash them with eighty lashes and do not accept from them testimony ever after. And those are the defiantly disobedient, Sahih International

সূরাঃ ২৪/ আন-নূর | An-Nur | سورة النور আয়াতঃ ৪ মাদানী

তাই আসুন, মহব্বত ধ্বংসকারী দোষ ত্রুটি থেকে আমরা বেঁচে থাকি এবং ভালোবাসা সৃষ্টিকারী গুণগুলোকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরি।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সকল প্রকার মন্দ ধারণা থেকে হিফাযত করুন। মন্দ কাজ ও কথা থেকে হিফাযত করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে পরিচ্ছন্ন হৃদয় ধারণ করার তাওফীক দান করুন। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল প্রকার গুনাহ থেকে আপনি আমাদের হিফাযত করুন।