পবিত্র কুরআন এর গুরুত্ব

Rumman Ansari   2023-04-07   Developer   islam > পবিত্র কুরআন   279 Share

সাধারণ অর্থে বাংলায় ‘গ্রন্থ বা বই', ইংরেজিতে 'বুক' এবং আরবি কিতাব হচ্ছে কতগুলো পরস্পর সম্পর্কিত লিখিত পাতার সমষ্ঠী যা সহজে পাঠযোগ্য ও বহনযোগ্য। এই পাতাগুলো হতে পারে বিভিন্ন উপাদানের বা উপাদান-সমষ্টির তৈরি। তবে একটি বইয়ের লিখিত বিষয়বস্তুকে বা বইটি যা ধারণ করছে- সেটিকেও বই বলা হতে পারে। কোন বই-এর গুরুত্ব ও উপযোগিতা হচ্ছে ঐ বইয়ে লিখিত বিষয়বস্তু। বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ও উপযোগিতার উপরই একটি বইয়ের গুরুত্ব ও উপযোগিতা নির্ভরশীল। কোন বই পাঠ করার পরই কেবলমাত্র ঐ বইটির গুরুত্ব ও উপযোগিতা উপলদ্ধি করা সম্ভব। কোন ব্যক্তি যখন কোন গ্রন্থ পাঠ করেন বা গ্রন্থ পাঠ শ্রবন করেন মূলতঃ ঐ রচনাতে যা বলা হচ্ছে, তিনি তা জানার চেষ্টা করেন। একজন ব্যক্তি যখন একটি গ্রন্থ নিজে পাঠ করছেন বা কারো পাঠ শ্রবণ করছেন, কিন্তু আদৌ কি পাঠ করছেন বা শ্রবণ করছেন তিনি সেসব শব্দের অর্থ জানেন না- বুঝতে পারেন না বা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন না- তখন তিনি প্রকৃত অর্থে কিছুই পাঠ করছেন না, তিনি কিছু অর্থহীন শব্দ উচ্চারন বা শ্রবণ করছেন মাত্র। তিনি শতবার সে শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করেন না কেন, তার কাছে সেসব শব্দ বা শব্দগুচ্ছ অর্থহীনই । ফলে ঐ বইটি তার কাছে গুরুত্বহীন । তবে যদি সে শব্দের উচ্চারণ সুরেলা বা শ্রুতিমধুর হয়, সেক্ষত্রে হয়ত এ শব্দ বা শব্দ সমষ্টি তার কাছে অর্থহীন হলেও তার হৃদয়ে এক ধরনের ব্যঞ্জনা হয়তো সৃষ্টি করতে পারে; কিন্তু তা তার জ্ঞানের জগতের কোন পরিবর্তন আনে না। কুরআন পাঠ অথবা শ্রবণের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কোন কারণ আছে কি?

পবিত্র কুরআনে ‘কুরআন কেন'- কি আছে সেখানে, ইসলাম ধর্মের সাথে আদৌ এর কি কোন সম্পর্ক আছে বা যেসব বিষয়ে বলা হয়েছে তার গুরুত্ব বা উপযোগিতা কতটুকু- এসব প্রশ্নের কুরআন কি বলছে সে উত্তর পেতে হলে অবশ্যয়ই কুরআন পাঠ করেই সে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। 

লক্ষনীয় যে, পবিত্র কুরআনে ‘কুরআন কেন'- এ গ্রন্থের বহু বাণীতে সে প্রশ্নের উত্তর যেমন দেওয়া হয়েছে সেই সাথে এ গ্রন্থের বর্ণিত বাণী, বিধান উপদেশ-ইত্যাদি মানুষের জীবনে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সে প্রসঙ্গও বহুভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

পবিত্র কুরআনে ‘কুরআন কেন’- এ প্রশ্নে কুরআনে বহু আয়াত রয়েছে। এসব আয়াতে, কুরআন কেন দেওয়া হয়েছে তার বহু কারণের মধ্যে যে প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার কয়েকটি :

1. বিশ্বাসীদের জন্য পথনির্দেশ

2. মানুষের জন্য উপদেশ

3. মানুষের জন্য বিধান

4. ভালো মন্দের পার্থক্য ও সত্য-অসত্য নির্ধারক

5. মতপার্থক্য মীমাংসাকারী বাণী

6. অতীতের সংবাদ

7. পরম শ্রষ্ঠার প্রতি আত্মসমর্পণ, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, প্রার্থনা ও কর্মের রীতি-নীতিসহ মানব আত্মা পরিশুদ্ধ করার কৌশল

8. অদৃশ্যের সংবাদ

9. এবং উপরে উল্লেখিত সকল বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা, উদাহরণ এবং উপমাসহ পূর্ণজ্ঞান

উল্লেখিত বিষয়সমূহ সম্পর্কিত বহু আয়াতের মধ্যে কয়েকটি :

'এই কুরআন মানবজাতির জন্য সুস্পষ্ট দলিল এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য পথনির্দেশ ও রহমত।” (45:20)

যিনি তোমার জন্য কুরআনকে করিয়াছেন বিধান, তিনি তোমাকে অবশ্যয়ই ফিরাইয়া আনিবেন জন্মভূমিতে--। (২৮ঃ৮৫)

“ রমাযান মাস, ইহাতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যা-সত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হইয়াছে।

।” (২ঃ১৮৫)

। এই কুরআন আমার নিকট প্রেরিত হইয়াছে যেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের যাহার নিকট ইহা পৌঁছিবে তাহাদিগকে এতদ্বারা (কুরআন দ্বারা) আমি সতর্ক করি।--------।” (৬ঃ১৯)

‘এবং শপথ তাহাদের যাহারা মানুষের অন্তরে পৌঁছাইয়া দেয় উপদেশ- ওজর-আপত্তি রহিতকরণ ও সতর্ক করার জন্য,” ( ৭৭ঃ ৫, ৬)

“শপথ আসমানের, যাহা ধারণ করে বৃষ্টি, এবং শপথ জমিনের যাহা বিদীর্ণ হয়, নিশ্চয় ইহা (আল-কুরআন) মীমাংসাকারী বাণী। এবং ইহা নিরর্থক নহে।” (৮৬ঃ ১১, ১২, ১৩, ১৪ )

“পূর্বে যাহা ঘটিয়াছে তাহার সংবাদ আমি এইভাবে তোমার নিকট বিবৃত করি এবং আমি আমার নিকট হইতে তোমাকে দান করিয়াছি উপদেশ।” (২০: ৯৯)

“আমি মানুষের জন্য এই কুরআনে বিভিন্ন উপমার দ্বারা আমার বাণী বিশদভাবে বর্ণনা করিয়াছি। মানুষ অধিকাংশ ব্যাপারেই বিতর্কপ্রিয়।” (১৮:৫৪ )

“এইরূপেই আমি কুরআন অবতীর্ণ করিয়াছি আরবি ভাষায় এবং উহাতে বিশদভাবে বিবৃত করিয়াছি সতর্কবাণী যাহাতে উহারা ভয় করে অথবা ইহা হয় উহাদের জন্য উপদেশ।” (২০ঃ ১১৩)

এভাবেই এক অদৃশ্য পরম সৃষ্টিকর্তা তার নিজের সম্পর্কে মানুষকে জ্ঞান, তার সকল সৃষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান, মানুষ সম্পর্কে জ্ঞান, মানুষের কোন কর্মের কি ফলাফল সে সম্পর্কে জ্ঞান দানসহ পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করেছেন।

কুরআন আরো জানাচ্ছে, এই জ্ঞান অর্জন এবং তা নিজ জীবনে সর্বতভাবে প্রতিফলন ও চর্চ্চার মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা ব্যতীত মানুষের জন্য চরম পরিণতি অপেক্ষা করছে।

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে কুরআন নিজে পাঠ করে হোক বা কারো পাঠ বা আবৃত্তি শুনে হোক- উল্লেখিত বিষয়ের কোন একটি সম্পর্কে ‘কুরআনের জ্ঞান' অর্জন করতে হলে কুরআনের বিকল্প কিছু আছে কি? অথবা ভিন্নভাবে বললে, উল্লেখিত বিষয়ে জ্ঞান অর্জন ব্যতীত কুরআন পাঠের আর কি প্রয়োজন থাকতে পারে?

কুরআন আরো বলে :

“আমি তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করিয়াছি মানুষের জন্য। অতঃপর যে সৎপথ অবলম্বণ করে সে তাহা করে নিজের কল্যাণের জন্য এবং যে বিপথগামী হয় সে তো বিপথগামী হয় নিজেরই ধ্বংসের জন্য। এবং তুমি উহাদের তত্ত্বাবধায়ক নহ।” (৩৯:৪১)

‘আল্লাহই অবতীর্ণ করিয়াছেন সত্যসহ কিতাব এবং তুলাদণ্ড।” (৪২:১৭ )

“আল্লাহর নিকট হইতে এক রাসুল যে আবৃত্তি করে পবিত্র গ্রন্থ, যাহাতে আছে সঠিক বিধান।” ( ৯৮ঃ৩)

উপরন্ত আল্লাহ সতর্ক করেছেন :

“আমি রাসুলকে কাব্য রচনা করিতে শিখাই নাই এবং ইহা তাহার পক্ষে শোভনীয় নহে। ইহা তো কেবল এক উপদেশ এবং সুস্পষ্ট কুরআন, যাহাতে সে সতর্ক করিতে পারে জীবিতগণকে এবং যাহাতে কাফিরদের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা সত্য হইতে পারে।” (৩৬ঃ ৬৯, ৭০)

সুতরাং কুরআন দাবি করছে, কুরআন কবিতা গ্রন্থ নয় যে কবিতা বা সঙ্গীতের সুরেলা কণ্ঠে এটি পাঠ করে পাঠকের বা শ্রোতার মনে ব্যঞ্জনার উদ্রেককরণই এই গ্রন্থ অবতীর্ণের উদ্দেশ্য। কুরআন দেওয়া হয়েছে এ কারণে যে মানুষ প্রধানত যারা বিশ্বাসী তারা এই গ্রন্থ পাঠ করে জ্ঞান অর্জন করবেন। যারা এই গ্রন্থকে কবিতার বই-এর মতো গণ্য করে এই গ্ৰন্থ থেকে জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে কবিতার সুরে বা সঙ্গীতের সুরেলা কণ্ঠে কুরআন পাঠ করে নিজের মনে ও শ্রোতার মনে ব্যঞ্জনার সৃষ্টির কাজটি করছেন, কুরআনের ভাষায় তারা প্রকারন্তরে আল্লাহর প্রিয় রাসুল (সঃ)-কে অশোভনীয়ভাবে উপস্থাপন করার দায়ে অভিযুক্ত। একটি শ্রেণী গত সাড়ে ১৪'শ বছর ধরে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বিভিন্ন কাহিনী ফেঁদে এই কাজটিকেই কুরআনের সকল উপযোগিতা হিসেবে অভিহিতকরণ করার মাধ্যম যারা এই ধারাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহ যোগাচ্ছেন এই আয়াতে তাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করা হয়েছে।

সুতরাং পবিত্র কুরআন যখন, তা ‘যথাথথভাবে পাঠ’ ও ‘মনোযোগ সহকারে শ্রবণ’, ‘নিবিষ্ট চিত্তে' বা 'অভিনিবেশ সহকারে' পাঠ ও শ্রবণ করার এবং এ সম্পর্কে ‘চিন্তা, অনুধাবন, উপলদ্ধি ও হৃদয়াঙ্গম' করার তাগাদা বা উপদেশ দিচ্ছে তখন এই গ্রন্থ যে শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের জন্য এই আয়াতের ব্যখ্যাটি কুরআন আরো স্পষ্ট করছে, তা বলাই বাহুল্য ।

আল্লাহ এ সম্পর্কে যা বলেন তার মধ্যে কয়েকটি আয়াত :

“ এক কল্যাণময় কিতাব, ইহা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করিয়াছি, যাহাতে মানুষ ইহার আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ গ্রহণ করে উপদেশ।” (৩৮:২৯)

“তবে কি উহারা কুরআন সম্পর্কে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে না? না উহাদের অন্তর তালাবদ্ধ?” (৪৭:২৪ )

“ইহাতে উপদেশ রহিয়াছে তাহার জন্য যাহার আছে অন্তকরণ অথবা যে শ্রবন করে নিবিষ্ট চিত্তে।” (৫০:৩৭ )

“তবে কি উহারা কুরআন সমন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে না? না উহাদের অন্তর তালাবদ্ধ?” (৪৭:২৪ )

“যাহাদিগকে আমি কিতাব দিয়াছি তাহারা যথাযথভাবে ইহা তিলওয়াত করে, তাহারাই ইহাতে বিশ্বাস করে; আর যাহারা প্রত্যাখ্যান করে তাহারাই ক্ষতিগ্রস্ত।” (২ঃ১২১)

----; তাহাদের হৃদয় আছে কিন্তু তদ্দারা তাহারা উপলদ্ধি করে না, তাহাদের চক্ষু আছে তদ্দারা তাহারা দেখে না এবং তাহাদের কর্ণ আছে তদ্দারা শ্রবণ করে না--ইহারা পশুর ন্যায়,------ ।” (৭৪১৭৯)

“আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জীব সেই, বধির ও মুক যাহারা কিছুই বোঝে না।” (৮ : ২২, ৫৫)

“উহাদের মধ্যে কেহ কেহ তোমার দিকে কান পাতিয়া রাখে। তুমি কি বধিরকে শুনাইবে, তাহারা না বুঝিলেও?” (১০:৪২ )

“উহাদের মধ্যে কেহ কেহ তোমার দিকে তাকাইয়া থাকে । তুমি কি অন্ধকে পথ দেখাইবে তাহারা না দেখিলেও?” (১০:৪৩ )

আল্লাহ বলেন :

আর তাহারা বলে, আমরা শুনয়াছি এবং পালন করিয়াছি। --।” (২ঃ২৮৫)

আল্লাহ আরো বলেন :

“সুতরাং উহারা ইহার (কুরআনের) পরিবর্তে আর কোন কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিবে?” (৭৭:৫০ )

“উহাদের কী হইয়াছে যে উহারা মুখ ফিরাইয়া লয় উপদেশ (কুরআন) হইতে ? উহারা যেন ভীত সন্ত্রস্ত গর্দভ, যাহা সিংহের সম্মুখ হইতে পলায়নপর । বস্তুতঃ উহাদের প্রত্যেকেই কামনা করে যে তাহাকে একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ দেওয়া হোক। না, ইহা হইবার নহে; বরং উহারা তো আখিরাতে ভয় করে না । না, ইহা হইবার নহে, কুরআনই সকলের জন্য উপদেশ। অতএব যাহার ইচ্ছা সে ইহা (কুরআন) হইতে উপদেশ গ্রহণ করুক।” ( ৭৪: ৪৯-৫৫)

সুতরাং কেন কুরআন, কি আছে কুরআনে, কেন পাঠ করতে হবে, কিভাবে পাঠ করতে হবে- ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে উপরে উল্লেখিত কুরআনের বর্ণনার পরে কোন বিশ্বাসীকে কি কুরআন পাঠের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত বলার প্রয়োজন আছে?

কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার প্রথম পর্যায়েই আল্লাহ তাহার রাসুলকে জানাচ্ছেন কুরআনের ‘সংরক্ষণ ও বিস্তারিত ব্যখ্যার দায়িত্ব' আল্লাহরই :

“তাড়াতাড়ি ওহি আয়ত্বের জন্য তুমি (রাসুল সঃ) তোমার জিহবা উহার সহিত সঞ্চালন করিও না, ইহা সংরক্ষন ও পাঠ করাইবার দায়িত্ব আমারই । সুতরাং যখন আমি উহা পাঠ করি তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কর, অতঃপর ইহার বিশদ ব্যখ্যার দায়িত্ব আমারই।” (৭৫ঃ ১৬, ১৯)

অতঃপর আল্লাহ কুরআনের আয়াতের বিশদ ব্যাখ্যা, কুরআনের বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা- ইত্যাদি প্রসঙ্গে যা বলেন, সে সম্পর্কে কুরআনে যে শতাধিক আয়াত অবতীর্ণ করেছেন তার মধ্যে কয়েকটি :

। আমি আত্মসমর্পণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ, পথ নির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদরূপে তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করিলাম।” (১৬:৮৯)

“ইহা দয়াময় পরম দয়ালুর নিকট হইতে অবতীর্ণ । এক কিতাব বিশদভাবে বিবৃত হইয়াছে ইহার আয়াতসমূহ, আরবি ভাষায় কুরআন, জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী। কিন্তু অধিকাংশ লোক মুখ ফিরাইয়া লইয়াছে, সুতরাং ইহারা শুনিবে না।” (৪১ : ২, ৩, ৪ )

“আমি তো মানুষের জন্য এই কুরআনে সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত দিয়াছি । - ” (৩০:৫৮)

“আর অবশ্যয়ই আমি মানুষের জন্য এই কুরআনে বিভিন্ন উপমা বিশদভাবে বর্ণনা করিয়াছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কুফরি করা ব্যতীত ক্ষ্যান্ত হইল না।” (১৭:৮৯)

‘এই কুরআন আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহারো রচনা নয় । পক্ষান্তরে ইহার পূর্বে যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে ইহা তাহার প্রত্যায়ন ও বিশদ ব্যাখ্যা। ইহাতে কোন সন্দেহ নাই যে ইহা জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হইতে।” (১০:৩৭ )

“ইহাই তোমার প্রতিপালকের নির্দেশিত সরল পথ। যাহারা উপদেশ গ্রহণ করে আমি তাহাদের জন্য আয়াতসমূহ (নিদর্শন) বিশদভাবে বিবৃত করিয়াছি।” (৬:১২৬)

-। ইহা এমন বাণী, যাহা মিথ্যা রচনা নয় । কিন্তু মু'মিনদের জন্য ইহা (কুরআনের বাণী) পূর্ব গ্রন্থে যাহা আছে তাহার প্রত্যায়ন এবং সমস্ত কিছুর বিশদ বিবরণ, হিদায়াত ও রহমত।” (১২ : ১১১ )

(বল), ----, এই কিতাব প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞের নিকট হইতে, ইহার আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট, সুবিন্যস্ত ও পরে বিশদভাবে বিবৃত যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করিবে না, অবশ্যয়ই আমি তাহার পক্ষে তোমাদের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা। (১১ : ১,২)

‘এইভাবে আমি আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করি, আর ইহাতে অপরাধীদের পথ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। (৬ : ৫৫)

আল্লাহ তার প্রিয় রাসুলের কাছে অঙ্গীকার করেছিলেন, কুরআনের বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব তারই এবং তিনি জানিয়েছেন যে তিনি আত্মসমর্পণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ পথ নির্দেশসহ কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। তিনি আরো বলেন কুরআনের আয়াতসমূহ সুস্পষ্ট, সুবিন্যস্ত ও বিশদভাবে বিবৃত এবং এই কুরআনের মধ্যেই সমস্ত কিছুর বিশদ বিবরণ রয়েছে।

এবং আল্লাহ তার রাসুলকে বলেন : “তুমি একনিষ্ঠ হইয়া নিজেকে দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করিয়াছেন, আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নাই। ইহাই সরল দ্বীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তাহা জানে না।” (৩০:৩০ )

“তুমি সরল দীনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত কর, আল্লাহর পক্ষ হইতে যে দিবস অনিবার্য তাহা উপস্থিত হইবার পূর্বে, সেই দিন মানুষ বিভক্ত হইয়া পড়িবে।” ( 30 : 43 )

“হে মুমিনগণ তোমরা সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করিও না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু । সুস্পষ্ট আয়াত তোমাদের নিকট আসিবার পর যদি তোমাদের পদস্খলন ঘটে তবে জানিয়া রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।” (২ : ২০৮, 209 )

“যাহারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করিতে চায়, ইহা (কুরআন) দ্বারা তিনি তাহাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে অন্ধকার হইতে বাহির করিয়া আলোর দিকে লইয়া যান। এবং উহাদিগকে সরল পথে পরিচালিত করেন।” (৫:১৬ )

সুতরাং কুরআনের দাবি অনুযায়ী কুরআন পূর্ণাঙ্গ। সেখানে কোন বিষয়ে যাই বলা আছে, অল্প কয়েক কথায় বলা আছে বা বহু বাক্য ব্যয়ে বলা হয়েছে সেটিই মানুষের জন্য যা প্রয়োজন সে সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ এবং চর্চ্চার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ । কুরআনের বিধান, আদেশ উপদেশ-যেভাবে বলা আছে, এই আদেশ উপদেশ পালনে যা বলা আছে যেভাবে পালন করতে বলা আছে- সেটিই বিস্তারিত এবং বিশদ বিবরণ। কুরআনের কোন আয়াতের ব্যাখ্য চাইলে সে ব্যখ্যাটিও কুরআনেই দেওয়া হয়েছে ।

একজন বিশ্বাসী নিজেকে সরল দ্বীনে একনিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে পথনির্দেশ, উপদেশ ও বিধান অনুসরণ করা প্রয়োজন তার সমস্ত কিছুই বিস্তারিতভাবে ব্যখ্যাসহ, উপমা, উদাহরণসহ পবিত্র কুরআনে দেওয়া আছে । আল্লাহ তার রাসুল মুহাম্মাদ (সঃ) এবং কুরআনের আয়াতে কোন ব্যক্তি যদি বিশ্বাসী হন, তার জন্য এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের কোন অবকাশ নেই । কোন ব্যক্তি যদি এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন অথবা যদি বলেন, কুরআনে বিস্তারিত বলা নেই— তিনি মূলত : আল্লাহ তার রাসুল মূহাম্মদ (সঃ) এবং কুরআনের আয়াতকে অবিশ্বাস করছেন অথবা কুরআনের প্রায় শতাধিক আয়াতকে অস্বীকার করছেন। দুটি ক্ষেত্রেই ঐ ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম এবং মুহাম্মাদ (সঃ)-এর অনুসারী হিসেবে দাবি করার অধিকার হারাবেন- এটিই যুক্তিসংগত ।

আল্লাহ বলেন :

‘যাহারা আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে তাহারা বধির, মুক, অন্ধকারে রহিয়াছে। যাহাকে ইচ্ছা আল্লাহ বিপথগামী করেন এবং যাহাকে ইচ্ছা তিনি সরল পথে স্থাপন করেন।” (৬ : ৩৯)

আল্লাহ আরো বলেন :

“অবশ্য আমি তাহাদিগকে পৌঁছাইয়াছিলাম এমন এক কিতাব যাহা * পূর্ণজ্ঞান' দ্বারা বিশদ ব্যাখ্যা করিয়াছিলাম -------। (৭:৫২ )

“পরন্তু আল্লাহ সাক্ষ্য দেন তোমার প্রতি যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তাহার মাধ্যমে। তিনি তাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন ' নিজ জ্ঞানে এবং ফেরেশতাগণও সাক্ষী দেয়। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট । (৪ : ১৬৬)

কুরআনের রচনাকারী স্বয়ং দাবি করেন, তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রেষ্ঠ, প্রজ্ঞাশীল, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী এবং সর্বোপরি তিনিই সর্ববিষয়ে একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্ত্বা। সুতরাং তার গ্রন্থ পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ।

বিষয়টি শুধু বিশ্বাসীদের জন্য একইভাবে কোন অবিশ্বাসী যখন ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইবেন বা ইসলামের কোন বিষয় সম্পর্কে কোন মন্তব্য করবেন- সে ইসলামের সমালোচনাই হোক বা অন্য কোন প্রসঙ্গেই হোক, তখন যুক্তিসংগতভাবেই তিনি কুরআনের ‘বিবরণ'কেই ভিত্তি হিসেবে ধরে সেটি করবেন। কোন ব্যক্তি বিশেষ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা কোন ইতিহাস, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য কিম্বা কারো কোন রচনাকে 'ইসলাম' হিসেবে দাড় করিয়ে সমালোচনা করা বা ইসলামকে দায়বদ্ধ করা হবে সাধারণ জ্ঞানে যেমন অযৌক্তিক এবং মূর্খতা তেমনি কুরআনের বর্ণনামতেই সে কাজটি অযৌক্তিক এবং মুর্খতারই শামিল।

কুরআন দাবি করছে, আল্লাহ তার পূর্ণ জ্ঞান দিয়ে কুরআনের বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কুরআনে যা আছে, তিনি নিজ জ্ঞানে তা অবতীর্ণ করেছেন। সুতরাং কুরআনের আয়াতের সাথে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি নিজেদের জ্ঞান জাহির করতে কুরআনের আয়তের বাইরের কোন দলিল-দস্তাবেজ তথ্য প্রমাণ, ঘটনার বর্ণনা এবং উদাহরণ-উপমা দিয়ে কুরআনের কোন আয়াতের বিস্তারিত ব্যখ্যা দেওয়ার কাজটি যখন করেন তিনি প্রকারন্তরে আল্লাহর জ্ঞানকেই চ্যালেঞ্জ করেন।

যখন বলা হয়, কুরআনে সরল দ্বীনে একনিষ্ঠভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট বা বিস্তারিত বলা হয়নি এবং এই দাবির সঙ্গে আল্লাহ প্রদত্ত বিধান, রীতি-নীতি, উপদেশের সাথে যারা নিজেদের নতুন নতুন আইন, বিধান, রীতি-নীতি, উপদেশ ইসলামের অংশ বা শরিয়ত হিসেবে দাবি করে ফতোয়া দেন, মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেন- তারা তাদের জ্ঞাতসারেই হোক বা অজ্ঞাতসারেই হোক কুরআনের বর্ণনামতে মূলত : আল্লাহর জ্ঞানকেই চ্যালেঞ্জ করছেন।

কুরআনের উল্লেখিত আয়াতসমূহ পরস্পর সম্পর্কিত এবং উল্লেখিত আয়াত সবগুলো একত্রে কুরআন কি ও কেন এবং ইসলামের সাথে তার সম্পর্কটি কি সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিচ্ছে। এই সাথে যদি আমরা কুরআনের মনূষ্য ব্যাখ্যা সম্পর্কিত একটি বহুল আলোচিত আয়াত সেগুলোর সাথে যোগ করি তবে সম্ভবত এ বিষয়ে কুরআনের ব্যখ্যাটি আরো স্পষ্ট হয়। একই সঙ্গে কুরআন থেকেই এই আয়াতটিরও একটি স্পষ্ট ব্যখ্যা পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন :

“তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করিয়াছেন যাহার কিছু আয়াত মুহকাম, এইগুলো কিতাবের মূল; আর অন্যগুলো মুতাশাবিহ, যাহাদের অন্তরে সত্য লংঘন প্রবণতা রহিয়াছে শুধু তাহারাই ফিতনা সৃষ্টি ও ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মুতাশাবিহের অনুসরণ করে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেহ ইহার ব্যখ্যা জানে না। আর যাহারা জ্ঞানে সুগভীর তাহারা বলে, আমরা ইহা বিশ্বাস করি, সমস্তই আমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে আগত'; এবং বোধশক্তি সম্পন্নরা ব্যতীত অন্য কেহ শিক্ষা গ্রহণ করে না।” (৩ :৭)

কুরআন ও ইসলাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত- কুরআনের এ সম্পর্কিত ব্যাখ্যাটি ইতোমধেই স্পষ্ট। এ পর্যায়ে যদি নিচের আয়াতটি যোগ করা হয় তবে উল্লেখিত ব্যাখ্যাটি আরো স্পষ্ট হয় :

*----। ---। আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করিলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পন্ন করিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করিলাম।----। ---।” (৫:৩)

সুতরাং ‘ইসলাম’ পূর্ণাঙ্গ করেছেন এবং পবিত্র কুরআনও পূর্ণাঙ্গ । কোন পূর্ণাঙ্গ বিষয়, সে কোন কাঠামোই হোক অথবা কোন রচনাই হোক, তার নির্মাণকারী বা রচনাকারী যখন ঘোষণা দেন তার কর্মটি পূর্ণাঙ্গ তখন সেই কাঠামো বা রচনা পূর্ণাঙ্গ বিবেচনা করেই সে কাঠামোর বা রচনার বিষয় বিবেচনা করেই তার মূল্যায়ন করাটিই যৌক্তিক। তার সাথে কোন কিছু সংযোজন বা বিয়োজন সে কাঠামো বা রচনার মৌলিকত্ব খর্ব, অঙ্গহানি, সৌন্দর্য বিনাশসহ বহু বিষয়ে ত্রুটিযুক্তকরণ হতে পারে। সে কাজটি করা হলে তার দায়-দায়িত্বও আর মূল কাঠামো নির্মাণকারী বা রচনাকারীর ওপর বর্তায় না। বিশেষ করে, যখন কোন কাঠামোর নির্মাণকারী বা কোন রচনার রচনাকারী নিজেই এই সংযোজন, বিয়োজন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা দেন- তখন এ সম্পর্কে কারও আর করণীয় কিছুই থাকার কথা নয়। পবিত্র কুরআনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি আরো কঠোরভাবে প্রযোজ্য হওয়া যুক্তিযুক্ত।

প্রথমত : এই গ্রন্থের রচনাকারী তার গ্রন্থের কোন বাণীর সাথে কিছু সংযোজন, বিয়োজন, বিকৃতিকরণ বা কোন বাণী আচ্ছাদন করার কাজটি থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এই নির্দেশ- এই একই গ্রন্থে কখনো সরাসরি কখনো বা বিস্তারিত ব্যাখ্যা, উপমা অতীতের অভিজ্ঞতা ও উদাহরণসহ বারবার কঠোরভাবে উচ্চারণ করা হয়েছে। সুতরাং একটি গ্রন্থ যখন নিজেই এসব কর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য বারবার হুঁশিয়ারি দেয়, তখন সে গ্রন্থে বর্ণিত ধর্মের কাঠামোর ক্ষেত্রে সেটি মেনে চলা নীতিগতভাবে যুক্তিসংগত। সুতরাং কুরআনে বা ইসলাম ধর্মে নতুন করে কোন বিধান, রীতি-নীতি উপদেশ, ব্যাখ্যা যোগ করার বা বিয়োজন করার কোন সুযোগ নাই ৷

আল্লাহ বলেন :

“সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়া তোমার প্রতিপালকের বাণী পরিপূর্ণ, তাহার বাক্য পরিবর্তন করিবার কেহ নাই। আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।” (৬ঃ১১৫)

“নিশ্চয়ই আমি যেসব স্পষ্ট আয়াত (নিদর্শন) ও হিদায়াত অবতীর্ণ করিয়াছি মানুষের জন্য কিতাবে উহা “স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার পরও যাহারা উহা গোপন রাখে আল্লাহ তাহাদিগকে লানত দেন এবং অভিশাপকারীরাও তাহাদেরকে অভিশাপ দেয়।” (২ঃ১৫৯ এবং ১৭৪, ১৭৫, ১৭৬)

“অনেকে অজ্ঞতাবশতঃ নিজেদের খেয়াল খুশি দ্বারা অবশ্যয়ই অন্যকে বিপথগামী করে; নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক সীমালংঘনকারীদের সম্মন্ধে সবিশেষ অবহিত।” (৬ঃ১২০ )

'যে ব্যক্তি আল্লাহ সমন্ধে মিথ্যা রচনা করে কিম্বা তাহার আয়াতকে অস্বীকার করে তাহার অপেক্ষা বড় জালিম আর কে ? -----। --- ।” ( ৭ : 37 )

“এইরূপে আমি মানব ও জ্বীনের মধ্যে শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবীর শত্রু করিয়াছি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাহাদের এক অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে।--------। সুতরাং তুমি তাহাদেরকে ও তাহাদের মিথ্যা রচনা বর্জন কর। আর তাহারা এই উদ্দেশ্যে প্ররোচিত করে যে, যাহারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাহাদের মন যেন উহার প্রতি অনুগামী হয় এবং উহাতে যেন তাহারা পরিতুষ্ট হয় আর তাহারা যে অপকর্ম করে তাহাই যেন করিতে থাকে।” ( ৬ : ১১২, ১১৩)

ঠিক যে ক্ষণে আল্লাহ ‘কুরআন ও ইসলাম’ পূর্ণাঙ্গ বলে ঘোষণা দিয়েছেন, ঠিক সেই ক্ষণটি থেকেই ‘কুরআন ও ইসলাম' তার একই কাঠামো ও রচনা নিয়ে স্বমহিমায় তার স্থানে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং এই কাঠামো ও রচনায় কোন পরিবর্তন নেই-সেটিই যুক্তিসংগত।

সুতরাং মানুষের সাধারণ জ্ঞানে যুক্তিসংগত হওয়া স্বাভাবিক যে, এই কাঠামো ও রচনার আওতায় থাকার অঙ্গীকারকারী বা এর মহিমা ঘোষণার নামে অথবা এটির বর্জনে বা বিরোধিতার মাধ্যমে মানুষ কি করেছে, সেটি মানুষের নিজস্ব কর্ম। মানুষের এসব কর্মের মাধ্যমে ইসলামে কোন কিছু যোগ বা বিয়োজন হওয়ার কোন কারণ নেই বা ঘটেওনি।

খোলাফায়ে রাশেদীনের চার খলিফা মদিনার শাসনভার গ্রহণ করে যা করেছেন, সে কর্মের দায়ভার তাদের। সে সময় অন্যেরা যা করেছেন, সে কর্মের দায়ভারও তাদেরই। এতে ইসলামে কোন কিছু যোগও হয়নি বা সে সময়ে কোন কর্মে বা কারো ইচ্ছায় ইসলামে কিছু বিয়োজনও ঘটেনি। একই উক্তি ইসলামের নামে পরবর্তী শাসকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, ইমাম, আলেম, মুহাদ্দেস, ফকিহ, বা স্কলার- যে নামেই কোন ব্যক্তিকে অভিহিত করা হোক না কেন- তিনি এক হাজার বছর আগে জন্মেছেন বা বর্তমানে জীবিত- সকলের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য হবে- কুরআনের ব্যাখ্যার আলোকে সেটিই কি যুক্তিসংগত হওয়ার কথা নয়?

সুতরাং কুরআনই ব্যাখ্য দিচ্ছে, ইসলাম ও কুরআন স্বমহিমায় একই স্থানে একইভাবে অবস্থিত । মানুষের কেউ কুরআন পাঠ করছেন, কুরআনের আয়াত অন্যজনের কাছে পৌঁছাচ্ছেন এবং নিজে সে উপদেশ পালন করছেন- কেউ আবার ভিন্ন কিছু করছেন- কে কিভাবে করছেন এবং একনিষ্ঠভাবে ইসলামে প্রবেশ করছেন কি-না- সেটি সম্পূর্ণ তার নিজস্ব কর্ম, তার নিজের লাভ-ক্ষতির বিষয়, তার কোন কর্মের দায়-দায়িত্ব যেমন আল্লাহ ও তার রাসুলের নয় এবং তার কোন কর্মে ইসলামের কাঠামোর সামান্যতম হ্রাস-বৃদ্ধি বা উজ্জ্বলতা-নিষ্প্রভতার কোন বিধান আল্লাহর রাসুল কুরআনে সংকলিত করেননি।

আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক মানুষই তার নিজ নিজ কর্মের জন্য দায়ী। সুতরাং কুরআন ও ইসলামের নামে কারো কর্ম, রচনা, মাজহাব, ব্যখ্যা, বিশ্লেষণ সেটি যার যার কর্ম দায়ভারও তারই। অন্য কোন ব্যক্তি সে দায়ভার বহন করবে না। আল্লাহ, ইসলাম বা আল্লাহর নবী-রাসুলগণ তো নয়ই। এ সম্পর্কিত পবিত্র কুরআনে বহু আয়াত আছে তার মধ্যে কয়েকটি :

“আমি তাহাকে পথের নির্দেশ দিয়াছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হইবে না হয় সে অকৃতজ্ঞ হইবে।” (৭৬ঃ ৩)

"প্রত্যেকেই স্বীয় কৃতকর্মের জন্য দায়ী এবং কেহ অন্য কাহারও ভার বহন করিবে না। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন তোমাদের প্রতিপালকের নিকটেই, তৎপর যে বিষয়ে তোমরা মতভেদ করিতে তাহা তিনি তোমাদিগকে অবহিত করিবেন।” (৬ঃ১৬৪)

“তোমরা সৎকর্ম করিলে সৎকর্ম নিজেদের জন্য করিবে এবং মন্দ কর্ম করিলে তাহাও করিবে নিজেদের জন্য।---------।” (১৭:৭)

“যাহারা সৎপথ অবলম্বন করিবে তাহারা তো নিজেদের মঙ্গলের জন্য সৎপথ অবলম্বন করিবে এবং যাহারা পথভ্রষ্ট হইবে নিজেদের ধ্বংসের জন্য এবং কেহ কাহারও ভার বহন করিবে না। ------। (১৭:১৫ )

“যে কেহ সৎকর্ম লইয়া আসিবে, সে ইহা হইতে উৎকৃষ্ট প্রতিফল পাইবে এবং সেই দিন ইহারা শংকামুক্ত থাকিবে।” (২৭:৮৯)

“যে কেহ অসৎকর্ম লইয়া আসিবে, তাহাকে অধোমুখে নিক্ষেপ করা হইবে দোজখে এবং (উহাদেরকে বলা হইবে), 'তোমরা যাহা করিতে তাহারই প্রতিফল তোমাদেরকে দেওয়া হইতেছে।” (২৭:৯০)

“যে কেহ সৎকর্ম লইয়া উপস্থিত হয় তাহার তাহার জন্য রহিয়াছে উহা অপেক্ষা উত্তম ফল, আর যে মন্দ কর্ম লইয়া উপস্থিত হয়, তবে যাহারা মন্দ কর্ম করে তাহাদিগকে তাহারা যাহা করিয়াছে উহারই শাস্তি দেওয়া হইবে।” (২৮:৮৪)

“যে কেহ সাধনা করে, সে তো নিজের জন্যই সাধনা করে; আল্লাহ তো বিশ্বজগৎ হইতে অমুখাপেক্ষি।” (২৯:৬)

সুতরাং কারো কর্ম যে কুরআনের অংশ তো নয়ই, বরং ইসলামেরও কোন অংশ নয়- যার যার কর্ম তার তার-সে ব্যাখ্যাও আল্লাহ কুরআনে স্পষ্টভাবেই দিয়েছেন।

আল্লাহ মানুষকে কুরআনের মাধ্যমে ভালো-মন্দের পার্থক্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কোন মানুষের উল্লিখিত কর্ম যদি আল্লাহর দৃষ্টিতে উত্তম বলে বিবেচিত হয়, তার শুভ ফলাফল সে কর্মের অধিকারীই ভোগ করবেন কিন্তু যদি মন্দ বলে বিবেচিত হয় সে মন্দের দায় ভারও তারই। আল্লাহ বলেন কে সৎকর্মপরায়ন বা কে মন্দকর্ম করেছে বা করছে তিনিই ভালো জানেন এবং এর চূড়ান্ত বিচারকও তিনি এবং রায়ও তিনিই দেবেন।

তবে যে বিষয়ে আল্লাহ স্পষ্টভাবে সনদ প্রদান করেননি অর্থ্যাৎ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি বা দিক নির্দেশনা দেননি সে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আল্লাহ মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। মানুষ তার চক্ষু, কর্ণ ও হৃদয় ব্যবহার করে অর্থাৎ তার জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে পরখ করে, সেসব বিষয়ে যেটি উত্তম মনে করবে, সেটিই সে আমল করবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সে উপদেশই প্রদান করেছেন। মানুষ এসব বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি মানুষের নিজস্ব সিদ্ধান্ত ।

মানুষের সিদ্ধান্ত কখনো চিরন্তন নয়। মানুষ তার নিজস্ব জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে কোন বিষয়ে কোনটি তার জন্য উত্তম- সে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যেমন সময়, পরিবেশ-পরিস্থিতি ইত্যাদির ওপর তার নিজস্ব ভালো-মন্দ বহুলাংশে নির্ভর করে তেমনি সময়ের সাথে সাথে মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেচনা শক্তি বৃদ্ধির ফলেও তার জন্য পূর্বের সিদ্ধান্তের তুলনায় আরো উত্তম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার উপায় রয়েছে।

মানুষের সামনে ইসলামের যে চিরন্তন কাঠামো ও ভালো-মন্দ পার্থক্যকারী স্পষ্ট চিরন্তণ বাণী, ‘ফুরকান স্বমহিমায় অবস্থান করছে- তা পাঠে প্রকৃত ইসলাম এবং গত ১৪'শ বছরে ইসলামের নামে বা ইসলামের বর্জন ও বিরোধিতার নামে কে কি করছেন সে সম্পর্কে যদি বিশ্বস্ত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় তাহলে- এ দুটির তুলনামূলক বিশ্লেষণ শেষে মানুষ এ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পেতে পারে মাত্র ।

ইসলামের বিধান আল্লাহ প্রদত্ত বিধান। আল্লাহর বিধানের কোন পরিবর্তন নেই। সুতরাং মানুষের কোন সিদ্ধান্ত ইসলামের কোন বিধি-বিধান নয়। নীতি-রীতি, বিধানের ক্ষেত্রে মানুষের সিদ্ধান্ত মানুষেরই কর্ম। ‘ইসলাম’ নামে বা ‘আল্লাহর বিধান' নামে তার প্রচার-প্রচারণাও কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াতের পরিপন্থী। আর যা আল্লাহর আয়াতের পরিপন্থী আল্লাহর দৃষ্টিতে তা গর্হিত অপরাধ ।

‘তাহাদের মধ্যে এমন কিছু নিরক্ষর লোক আছে যাহাদের মিথ্যা আশা ব্যতীত কিতাব সমন্ধে কোন জ্ঞান নাই তাহারা শুধু অমূলক কথা বলে। সুতরাং দুর্ভোগ তাহাদের জন্য যাহারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং তুচ্ছ মূল্যপ্রাপ্তির জন্য বলে, 'ইহা আল্লাহর নিকট হইতে। তাহাদের হাত যাহা রচনা করিয়োছে তাহার জন্য শাস্তি তাহাদের এবং যাহা তাহারা উপার্জন করে উহার জন্য শাস্তি তাহাদের।” (২ঃ ৭৮, ৭৯)